ব্লাড প্রেসার বেসিকস’এর এই সেকশনে আপনাকে স্বাগতম। এই সহজ গাইডলাইনে আমরা জানবো – ব্লাড প্রেসার আসলে কি? এর বিভিন্ন ধরন, প্রকারভেদ, নরমাল ব্লাড প্রেসার ও হাই ব্লাড প্রেসারের মধ্যে পার্থক্য, কিভাবে বুঝবেন আপনার ব্লাড প্রেসার কোন অবস্থায় আছে, কেন এটি নিয়মিত চেক করা অবশ্যই উচিৎ ইত্যাদি।
সূচিপত্র
ব্লাড প্রেসার কি?
সহজ ভাষায় বললে ব্লাড প্রেসার হচ্ছে আপনার শরীরে হার্টবিটের মাধ্যমে শিরায় ও ধমনীতে যে গতিতে আপনার রক্ত চলাচল করে সেই গতি বা প্রেসারটাই হচ্ছে আপনার ব্লাড প্রেসার। রক্ত চলাচলের সময় রক্তের ধমনীর গায়ে রক্তের যে প্রেসার থাকে তাকেই ব্লাড প্রেসার বলে।
আমাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে অক্সিজেন ও নিউট্রিয়েন্টস পৌঁছানোর কাজে এই ব্লাড প্রেসারটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, উচ্চ রক্তচাপেরই আরেক নাম হাইপারটেনশন। যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা এনএইচএস হাইপারটেনশনকেই হাই ব্লাড প্রেশার বা উচ্চ রক্তচাপ বলে বর্ণনা করছে।
বাংলাদেশে ৪.৫ কোটি কিংবা প্রতি ৪ জনে ১ জন মানুষ হাই ব্লাড প্রেসারে আক্রান্ত
– NCDC Bangladesh Research
বাংলাদেশে এক চতুর্থাংশ মানুষ হাইপারটেনশন বা যাকে সাধারণভাবে আমরা উচ্চ রক্তচাপ বলে জানি, তাতে ভুগছেন বলে চিকিৎসকেরা বলছেন। আর তাতে পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি ভুগছেন। আমাদের শরীরে স্বাভাবিক নিয়মেই রক্তচাপ দিনের বিভিন্ন সময় কিছুটা পরিবর্তিত হয়। ঘুমের সময় মানুষের রক্তচাপ কম থাকে। ঘুম ভাঙার কয়েক ঘণ্টা পরে কিছুটা বেড়ে যায়, বিকাল নাগাদ রক্তচাপ সর্বোচ্চ হয়। আবার রাতে ঘুমের সময় কমে আসে।
শরীরে অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে গেলে প্রেসারও বাড়ে। খাদ্য পরিপাক কিংবা ব্যায়ামের সময় বেশি অক্সিজেন প্রয়োজন হয়।
ব্লাড প্রেসারের প্রকারভেদ?
যখন আপনি আপনার ব্লাড প্রেসার মনিটর করবেন (মাপবেন) তখন আপনি সাধারনত ২ টি নম্বর দেখতে পাবেন। যেমনঃ ১২০/৮০ বা ১৪০/১১০। এখানের প্রথম বড় সংখ্যাটি হচ্ছে সিস্টোলিক ব্লাড প্রেসার ও পরের সংখ্যাটি হচ্ছে ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ।
সিস্টোলিক ব্লাড প্রেসারঃ হার্টের সংকোচনের সময়কে সিস্টোল বলা হয়। রক্ত হৃদপিণ্ডের সংকোচনের ফলে ছিটকে বের হয়ে ধমনীতে প্রবেশ করে। এ সময় ধমনীর দেওয়ালে রক্তের যে চাপ তৈরি হয় তাকে সিস্টোলিক রক্তচাপ বলা হয়। স্বাভাবিক ভাবে শান্ত অবস্থায় সিস্টোলিক রক্তচাপ হবে ১২০ মিলিমিটার মার্কারি অথবা তার কম। মানসিক চাপ, পরিশ্রম, বা হার্ট দ্রুত গতিতে চলবে এমন যে কোনো ঘটনায় সিস্টোলিক রক্তচাপ বেড়ে যায়। উচ্চ রক্তচাপ থাকলে শান্ত অবস্থাতেও এর মান ১২০ মিলিমিটার মার্কারির বেশী হতে পারে। অনেক বেশী পানি শূন্যতায়, কোনো আঘাতে অতিরিক্ত রক্তপাত হলে বা হার্টের মাংসপেশি দুর্বল হয়ে গেলে সিস্টোলিক হাইপোটেনশন বা স্বাভাবিকের চেয়ে কম সিস্টোলিক রক্তচাপ দেখা দিতে পারে।
ডায়াস্টোলিক রক্তচাপঃ হার্টের সংকোচন শেষ হবার পরে এর চেম্বার বা নিলয়গুলি শিথিল হয়ে তাতে আবার রক্ত এসে জমা হয়, পরের সংকোচনের প্রস্তুতি হিসেবে। এই সময়টাকে বলা হয় ডায়াস্টোল। আর এসময়ের রক্তচাপকেই বলা হয় ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ। স্বাভাবিকভাবে ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ হবে ৮০ মিলিমিটার মার্কারি অথবা তার কম। উচ্চ রক্তচাপ থাকলে শান্ত অবস্থাতেও এর মান বেশী হতে পারে। আর পানিশূন্যতায় বা অতিরিক্ত রক্তপাতের ফলে ডায়াস্টোলিক হাইপোটেনশন দেখা দিতে পারে।
নরমাল vs হাই ব্লাড প্রেসার
ব্লাড প্রেসার নরমাল বা স্বাভাবিক থাকা মানে আপনার স্বাস্থ্য’ও স্বাভাবিক অবস্থায় আছে। অর্থাৎ আপনার হার্ট সঠিকভাবে আপনার ব্লাড সারা শরীরে পাম্প করছে এবং আপনার ধমনীগুলোও রিলাক্সড ও হেলদি অবস্থায় আছে।
অন্যদিকে হাই ব্লাড প্রেসার মানে হচ্ছে আপনার ধমনীতে রক্তের অতিরিক্ত চাপ বা গতি। এই চাপের কারনে আপনার ধমনি এবং আপনার হার্টে সময়ের সাথেসাথে চাপ তৈরি করে এবং এটিই আল্টিমেটলি সিরিয়াস হেলথ ইস্যু সৃষ্টি করে।
হাই ব্লাড প্রেসারের ঝুঁকি
হাই ব্লাড প্রেসারকে, যা ‘হাইপারটেনশন’ নামেও আমরা জানি, অনেক সময়ই “সাইলেন্ট কিলার” বা নীরব ঘাতক নামে ডাকা হয় কারন বেশিরভাগসময় এর কোনো সিম্পটমস বা লক্ষন থাকে না বা থাক্লেও তা বুঝতেই পারা যায় না। এমনকি যে হাই ব্লাড প্রেসারে এই মুহূর্তে আক্রান্ত সে নিজেও বেশিরভাগ সময় বুঝতে পারে না যে তার ব্লাড প্রেসার এখন হাই।
আর যদি এভাবেই ব্লাড প্রেসার যে হাই তা যদি না জানেন বা জানলেও তা নরমাল অবস্থায় আনার জন্য পদক্ষেপ না নেন তো তা আপনার রক্তের ধমনি, হার্ট, ব্রেইন, কিডনি এবং অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গেরও ক্ষতি করতে পারে যার ফলে আপনার হার্ট আট্যাক, স্ট্রোক, কিডনির সমস্যা সহ নানা জটিল সমস্যা তৈরি এবং বৃদ্ধি করে দেয়।
আপনি জানেন কি? ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত রিসেন্ট একটি গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ২.২ কোটি হাই ব্লাড প্রেসারে আক্রান্ত! অনিয়ন্ত্রিত লাইফস্টাইলের কারনে যার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। এবং এই আক্রান্তের তালিকায় যে শুধু বয়স্করাই তা কিন্তু নয়। বরং ১৮ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সের প্রাপ্তবয়স্করাও হাই ব্লাড প্রেসারে একটি বড় সংখায় আক্রান্ত। শুধু তাই নয়, অনিয়ন্ত্রিত লাইফস্টাইলের কারনে অনেক অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেও হাই ব্লাড প্রেসার দেখতে পাওয়া যায়।
কিন্তু স্বস্তির খবর এই যে, সচেতনতা এবং নিয়ন্ত্রিত সাধারন লাইফস্টাইল, ছোট ছোট কিছু পরিবর্তন ও অভ্যাসের মাধ্যমে আপনি আপনার ব্লাড প্রেসার কন্ট্রোল করতে পারবেন এবং এই সংক্রান্ত আপনার স্বাস্থ্যের নানা কমপ্লিকেশন কমিয়ে আনতে পারবেন যার ফলে আপনি আপনার বা আপনার প্রিয়জনদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারবেন।
তাই চলুন, আমরা আমাদের সুস্বাস্থ্যের জন্য ব্লাড প্রেসারের দিকে নজর রাখি এবং একে নরমাল পর্যায়ে রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ যা যা দরকার তা করি।